শুক্রবার, ৫ই জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
২১শে আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জনসংখ্যা বাড়াতে কোটি কোটি ডলার খরচ করছে যেসব দেশ

নিউজ ডেস্ক

🕒 প্রকাশ: ০৪:৩৮ অপরাহ্ন, ১৩ই সেপ্টেম্বর ২০২৩

#

ছবি-সংগৃহীত

চলতি বছরের শুরুর দিকে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ হিসেবে চীনকে ছাড়িয়ে গেছে ভারত। বিপরীতে ২০২২ সালে চীনের জনসংখ্যা কমেছে ৮,৫০,০০০। ১৯৫৯-১৯৬১ সালের দুর্ভিক্ষের পর এই প্রথম জনসংখ্যা হ্রাস পেয়েছে চীনের।

যদিও বর্তমানে চীনের ১৪০ কোটি জনসংখ্যার বিবেচনায় এই হ্রাসটি পরিমিত বলে মনে হতে পারে। তবে জনসংখ্যার এই হ্রাসের পরিসংখ্যান অব্যহত থাকলে ২১০০ সালের মধ্যে চীনের জনসংখ্যা ৮০ কোটিরও নিচে নেমে যেতে পারে বলে অনুমান করছে জাতিসংঘ।

অভিবাসন, দেশত্যাগ, মৃত্যু এবং জন্মহারের মাধ্যমে জনসংখ্যা ওঠানামা করে। চীনের পূর্ববর্তী এক সন্তান নীতি প্রয়োগ করা হয়েছিল ১৯৮০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত এবং এর ফলে লিঙ্গ ভারসাম্যহীনতার কারণে সেখানে জন্মহার হ্রাস পেয়েছে। চীন সরকার এখন গর্ভপাতকে নিরুৎসাহিত করে জন্মহার বাড়ানোর চেষ্টা করছে।

১৮ শতকে প্রকাশিত ম্যালথুসিয়ান তার জনসংখ্যা বৃদ্ধির মডেলে বলেন, জনসংখ্যা দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পায় এবং দুর্ভিক্ষ, রোগ, সংঘাত বা অন্য কোনো দুর্যোগে মহামারি ঘটার আগ পর্যন্ত তা সম্পদের প্রাপ্যতাকে ছাড়িয়ে যায়।

১৯৬০-এর দশকের গোড়ার দিকে বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল অনেক উচ্চ। সেসময় বিভিন্ন দেশে জনসংখ্যা একটি বিরাট উদ্বেগের কারণ হয়ে ওঠে। তবুও বিশ্বজুড়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধি নাটকীয়ভাবে হ্রাস পেয়েছে এবং চীনসহ অন্যান্য অনেক দেশে জনসংখ্যার বৃদ্ধি না ঘটে উল্টো কমছে।

ল্যানসেট মেডিকেল জার্নালে ২০২০ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০টিরও বেশি দেশে যেভাবে জনসংখ্যা কমছে তাতে ২১০০ সাল নাগাদ এসব দেশে জনসংখ্যা অর্ধেকে নেমে যাবে।

এ ছাড়া পিউ রিসার্চ থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক ঘোষণা করেছে, ২১০০ সাল নাগাদ অন্তত ৯০টি দেশে জনসংখ্যা হ্রাস পাবে এবং ২০৭০ থেকে ২০৮০ সালের মধ্যে বিশ্বের মোট জনসংখ্যা হবে ৯৮০ কোটি।

জনসংখ্যা সঙ্কুচিত হওয়ায় ভয় পাচ্ছেন বিভিন্ন দেশের সরকার এবং অর্থনীতিবিদরা। কারণ, জনসংখ্যা সঙ্কুচিত হতে থাকলে আজকের কর্মক্ষম জনশক্তি ৩০ বছর পর বার্ধক্যে চলে যাবে। তখন কর্মক্ষম জনশক্তির অভাব দেখা দেবে।

বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের এই নিম্নমুখিতার অন্যতম কারণ নারীর উর্বরতা হ্রাস। উর্বরতা এবং জন্মের হার পরিমাপ করে বিভিন্ন মেট্রিক্সে দেখায় একজন নারী তার জীবদ্দশায় গড়ে সাধারণত ২.১টি শিশুর জন্ম দেন।

বিশ্বব্যাপী নারীর উর্বরতার হার হ্রাসের জন্য দায়ী করা যেতে পারে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন, পরিবার-পরিকল্পনা উদ্যোগ, গর্ভনিরোধের ব্যাপক ব্যবহার, উচ্চ শিশু মৃত্যুর হার, শিশু লালন-পালনের বর্ধিত ব্যয়, নগরায়ন, বিলম্বিত বিবাহ এবং শিক্ষাগত ও ক্যারিয়ারের কারণে সন্তান জন্মদানে দেরির মতো বিষয়গুলোকে।

জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্যোগ নিয়ে বিপদে পড়েছে অনেক দেশ। সেসব দেশ আবার বিভিন্নভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে। সন্তান জন্মদানে নারীদের উৎসাহিত করা, অর্থ প্রদান, সন্তান লালন পালনের ব্যয়ভার সরকারিভাবে বহন করা সহ নানা ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে এসব দেশ।

কেন এবং কীভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ

উত্তর-পূর্ব এশিয়া

জন্মহার হ্রাসজনিত সমস্যার একটি বড় উদাহরণ জাপান। ২০০৮ সালে জাপানের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১৩ কোটি। সেখানে ২০২৩ সালে দেশটির জনসংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১২.৩ কোটি। চলতি শতাব্দীর শেষ নাগাদ এই সংখ্যা ৭ কোটিতে নেমে যেতে পারে।

নিম্ন উর্বরতার হার, বার্ধক্যজনিত জনসংখ্যা হ্রাস এবং সীমিত অভিবাসন নীতিতে জনসংখ্যার নিম্নমুখী এ ধারা অব্যাহত রয়েছে জাপানে। এই পতনকে ধীর করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে দেশটি। এসব উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে অভিবাসন আইন পরিবর্তন, সরকারি খরচে বিয়ের ব্যবস্থা এবং সন্তান লালনপালনে সরকারি সহযোগিতা।

লক্ষণীয়ভাবে, ২০২২ সালে জাপানের জন্মহার রেকর্ড পরিমাণ কম হওয়া সত্ত্বেও, তা এখনও চীন এবং দক্ষিণ কোরিয়ার চেয়ে বেশি। ২০০৬ সাল থেকে জন্মহার বাড়ানোর চেষ্টা করছে দক্ষিণ কোরিয়া।

জন্মহার বাড়ানোর জন্য দেশটি পাবলিক ডে কেয়ার সেন্টার, বিনামূল্যের নার্সিং, শিশু লালন পালনে ভর্তুকিসহ অন্যান্য উদ্যোগে ২০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি বিনিয়োগ করেছে। কিন্তু ০.৭৮ রেট-এ দক্ষিণ কোরিয়ার জন্মহার বিশ্বের সর্বনিম্ন রয়ে গেছে।

ইউরোপ

কয়েক দশক ধরে জনসংখ্যা বাড়ানোর প্রচেষ্টা চলছে ইউরোপে। উদাহরণস্বরূপ, রোমানিয়া ১৯৬৬ সালে গর্ভনিরোধকে নিষিদ্ধ করে এবং কিছু নির্দিষ্ট অসুস্থতার ক্ষেত্র ব্যতীত গর্ভপাতকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে। ফলস্বরূপ, দেশটিতে অবৈধ গর্ভপাত বৃদ্ধি পায় এবং ১৯৮০-এর দশকে রোমানিয়ায় মাতৃমৃত্যুর হার ছিল ইউরোপের মধ্যে সর্বোচ্চ।

রোমানিয়ায় ১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে জন্মহার ২.৩-এ স্থিতিশীল থাকলেও, ১৯৯০-এর দশকে সেটি একদমই কমে যায়। পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের পর দেশত্যাগের মাধ্যমেও রোমানিয়ায় জনসংখ্যার হ্রাস পেতে থাকে। দেশটি জনসংখ্যার বাড়ানোর জন্য বিভিন্নভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যান্য পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোর অবস্থাও একইরকম। সেসব দেশেও জন্মহার হ্রাস এবং দেশত্যাগ বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে।

বিপরীতে, পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলোতে ২০০০ সাল থেকে জনসংখ্যা সামান্য বৃদ্ধি পেয়েছে, তবে মূলত তা ঘটেছে অভিবাসনের কারণে। তা সত্ত্বেও, ইতালির মতো দেশের জনসংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। ছোট ছোট শহরগুলোকে টিকিয়ে রাখার জন্য তারা প্রয়াসে বিদেশিদের জন্য ১ ইউরোতে বাড়ি দেওয়ার জন্য সরকারের উদ্যোগকে উৎসাহিত করেছে।

যুক্তরাষ্ট্র বেশিরভাগ ইউরোপীয় দেশগুলোর তুলনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের গড় আয়ু কম। ২০০০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্মহার স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু ২০০৮ সালে মন্দার পরে এটি হ্রাস পায় এবং তারপর এটি আর স্বাভাবিক হয়নি।

অভিবাসনের মাধ্যমে এই সমস্যা কিছুটা প্রশমিত করেছে। তবে ইউরোপের মতো এটি ক্রমবর্ধমানভাবে রাজনৈতিক হয়ে উঠেছে এবং মার্কিন জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার যথেষ্ট ধীর হয়ে গেছে।

জন্মহার বাড়ানোর জন্য কোনো সরকারি নীতি না থাকলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিদেশে পরিবার-পরিকল্পনা উদ্যোগকে উৎসাহিত করে।

রাশিয়া

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়ার জন্মহার দ্রুত পতনের সম্মুখীন হয়। ১৯৯৯ সালে রাশিয়ার জন্মহার সর্বনিম্ন ১.১৬-এ পৌঁছে এবং জনসংখ্যা হ্রাস পায়। তবে, সরকারি উদ্যোগে ২০১৪ সালে আবার তা ১.৮-এ ফিরে আসে।

ক্রেমলিন ২০২০ সালে ঘোষণা করেছে, ১.৭ হারে জন্মহার রাশিয়ার জন্য প্রয়োজন। এজন্য দেশটি কমপক্ষে দুই সন্তানের পিতামাতা হওয়াকে উৎসাহিত করেছে এবং এর জন্য অর্থপ্রদান বৃদ্ধি করেছে। এ ছাড়া জনসংখ্যাকে আরও স্থিতিশীল করার জন্য অভিবাসনের ওপরও নির্ভর করছে রাশিয়া।

আরো পড়ুন: আত্মহত্যা নয় বরং বেঁচে থাকাই জীবন

ইরান

গত কয়েক দশকে ইরানের জন্মহার নীতি একাধিকবার পরিবর্তন করা হয়েছে। ১৯৫০-এর দশকে ইরান জন্মহার কমানোর উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর সেই নীতিগুলোকে বাতিল করা হয়। তবে অর্থনীতির ওপর চাপ কমানোর জন্য ১৯৯০ সালের দিকে পুনরায় জন্মহার কমানোর উদ্যোগ চালু করা হয়। ২০১২ সালের দিকে দেশটিতে হঠাৎ করে জন্মহার কমে ১.৬-এর নিচে নেমে গেলে সরকার জন্ম নিয়ন্ত্রণ, গর্ভপাত এবং ভ্যাসেক্টমিতে অ্যাক্সেস সীমিত করে জন্মহার বাড়ানোর প্রচেষ্টা শুরু করে।

দক্ষিণ এশিয়া

যদিও ভারত এখন বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশের তকমা ধারণ করেছে, তবুও ভারতে জন্মহার এই মুহূর্তে স্বাভাবিকের চেয়েও কম। তবে ভারতের জনসংখ্যা বাড়তে থাকবে। কারণ, ভারতের মোট জনসংখ্যার বড় অংশটিই তরুণ। এ ছাড়া জনসংখ্যাগত বৈশিষ্ট্যে গ্লোবাল সাউথজুড়েই জন্মহার স্বাভাবিক।

জন পি রুহেল : অস্ট্রেলিয়ান-আমেরিকান সাংবাদিক, ভাষান্তর : মুজাহিদুল ইসলাম

এসি/  আই.কে.জে/




জনসংখ্যা বিলিয়ন ডলার

খবরটি শেয়ার করুন